ভাবতে আশ্চর্য লাগে, কমিউনিস্ট আদর্শ ছাড়া যাঁরা আর কোনও ধারণাকে স্বীকার করেন না, তাঁরা আজ নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এক সময়ের প্রধান শত্রুকেও গলায় জড়িয়ে ধরে বন্ধু হয়ে যান! আসল কথা হল, কমিউনিস্টদের সবই মিথ্যে। আদর্শের নামে মানুষকে সবসময় বিভ্রান্ত করে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ পূরণ করে যাওয়াটাই কমিউনিস্ট বা বামেদের একমাত্র নীতি।
উপমন্যু রায়
মইদুলের মৃত্যুর কথা এখন নিশ্চয়ই সকলের জানা। মইদুল ইসলাম মিদ্যা। বাঁকুড়ার কোতুলপুরের বাসিন্দা। সক্রিয় বামকর্মী হিসেবেই ছিল তাঁর পরিচিতি। ১২ ফেব্রুয়ারি (বৃহস্পতিবার) বাম ছাত্র–যুব সংগঠন নবান্ন অভিযানের ডাক দিয়েছিল। ওই অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন মইদুল।
ওই অভিযানে মধ্য কলকাতার কিছু এলাকা রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে। পুলিশ ও বাম কর্মী–সমর্থকরা সঙ্ঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। ধর্মতলার ডোরিনা ক্রসিংয়ে মইদুলকে পুলিশ লাঠিপেটা করে বলে অভিযোগ। জখম অবস্থায় তাঁকে ভর্তি করা হয় মধ্য কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে। সোমবার তাঁর মৃত্যু হয়।
বামেদের অভিযোগ, পুলিশের মারেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। শুধু তাই নয়, এই ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগও তুলেছেন বাম নেতারা। অর্থাৎ, তাঁর মৃত্যুর জন্য দায়ী পুলিশ।
এখন প্রশ্ন হল, পুলিশ কার? ভারতে পুলিশ স্বয়ংশাসিত কোনও বিভাগ নয়। রাজ্য সরকারের অধীনস্ত একটি বিভাগ মাত্র। তাই মইদুলের মৃত্যুর জন্য দায়ী করা যায় পশ্চিমবাংলার তৃণমূল সরকারকেই।
নবান্ন অভিযানে পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে পরদিন, অর্থাৎ ১৩ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার বাংলায় ধর্মঘটের ডাক দেয় তারা। অর্থাৎ, বামেদের নিশানায় রয়েছে সেই তৃণমূল। এটা পরিষ্কার। আর এখানেই লুকিয়ে তাদের সীমাহীন ভণ্ডামি। কারণ, নির্লজ্জ সত্য হল, মইদুলের মৃত্যুর জন্য পুলিশ বা প্রশাসন নয়, তৃণমূল সরকারও নয়, মূল দায়ী বাম নীতি নির্ধারকরাই।
কারণটা বলছি। তার আগে সকলেরই আজ এই প্রশ্নের উত্তর জানাটা দরকার, কেন তাঁরা লোক দেখানো নবান্ন অভিযানের ডাক দিয়েছিলেন? কেন বাম কর্মীদের পুলিশের সঙ্গে সঙ্ঘর্ষে জড়িয়ে পড়া থেকে আটকাতে পারেননি? নাকি, রাজ্যের পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের কথাই সত্য?
মইদুলের মৃত্যু নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে সুব্রতবাবু বলেছেন, ‘সিপিএম মার খেতেই ছেলেগুলোকে নবান্ন অভিযানে পাঠিয়েছিল। যাতে তা থেকে রাজনৈতিক ফায়দা তোলা যায়।’
বাস্তবিকই মইদুলের মৃত্যু নিয়ে বাম নেতারা আজ নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারেন না। কেন না, সবচেয়ে বড় কথা হল, তাঁদের কেউই আজ নিশ্চিত ভাবে বলতে পারবেন না যে, ভোটের পরও তৃণমূলই তাঁদের প্রধান প্রতিপক্ষ থাকবে! বা, থেকে যাবে।
আসলে পশ্চিমবাংলায় নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেই তৃণমূলের বিরুদ্ধে আজ লড়াইয়ে নামতে হয়েছে তাঁদের। পাশাপাশি নিজেদের গুরুত্ব ফিরে পেতে কংগ্রেসের সঙ্গে জোটও করতে হয়েছে।
কংগ্রেসের সঙ্গে জোট প্রক্রিয়া চলাকালীন একটি দাবি বাতাসে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন কিছু বাম নেতাই। বিহারের বিধানসভা নির্বাচনে কিছুটা ভালো ফল করার পরই সেখানকার এক বাম নেতা তো জানিয়েই দেন, বিজেপি এখন দেশে বিপজ্জনক একটি শক্তি। অতএব ওই দলকেই আগে রুখতে হবে। তাই বাংলায় বামেদের তৃণমূলকেও সঙ্গী করা উচিত।
ব্যস, এর পর তথাকথিত বাম মনোভাবাপন্ন কিছু ব্যক্তি বাংলার কিছু সংবাদ মাধ্যমে ফলাও করে পর পর উত্তর সম্পাদকীয় লিখতে শুরু করে দিলেন। প্রশ্ন তুললেন, বিজেপি যে মূল শত্রু, কেন তাঁরা বুঝতে চাইছেন না? কেন বিজেপিকে রুখতে তৃণমূলকেও সঙ্গী করা হচ্ছে না?
কিন্তু বাংলার বাম নীতি নির্ধারকরা এখনই তাঁদের যুক্তি মানতে পারেননি। মানলে পশ্চিমবাংলায় তাঁদের যে যুক্তিহীন হয়ে যেতে হবে! সত্যি কথা বলতে কী, এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে এই তৃণমূলই বামেদের রাজ্যের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেছিল। সেই তাদের সঙ্গে জোটে গেলে নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে বাংলার সাধারণ মানুষের কাছে, বিশেষ করে বাম কর্মী–সমর্থকদের কাছে কী কৈফিয়ত দেবেন তাঁরা?
কিন্তু, আমি হলফ করে বলতে পারি, বাম বা কমিউনিস্টদের এই মনোভাবও একটা ভণ্ডামো ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ, বাংলার বিধানসভা নির্বাচনের ফল যদি ত্রিশঙ্কু হয় (যা হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে), সে ক্ষেত্রে বিজেপিকে রুখতে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে ক্ষমতায় রাখার অজুহাতে তৃণমূলকেই সমর্থন করবেন তাঁরা।
হ্যাঁ, এই পথই তাঁরা নেবেন। আর এটাই সত্য।
তখন তাঁরা বিজেপিকে রোখার পাশাপাশি এই যুক্তিও দেখাতে পারেন, রাজ্য তথা দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। তাঁরা যদি তৃণমূলকে সমর্থন না করেন, তা হলে ফের নির্বাচন করতে হবে। তাতে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। এই টাকা তো সাধারণ মানুষেরই!
যদি তা–ই হয়, তা হলে এই প্রশ্ন করা অন্যায় হবে কি যে, নবান্ন অভিযান করার বা পশ্চিমবাংলায় ধর্মঘট ডাকার ভণ্ডামো তাঁরা দেখিয়েছিলেন কেন? কারণ, তৃণমূল যে সবসময় তাঁদের কাছে অচ্ছুত থাকবেই, সে কথা তো তাঁরা কেউই হলফ করে বলতে পারবেন না!
নবান্ন অভিযানের ভণ্ডামো না দেখালে তো মইদুলকে এ ভাবে মরতে হত না! (এখন তো শোনা যাচ্ছে, ওই অভিযানে অংশ নেওয়া আরও এক বাম কর্মীর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।) আজ মইদুলের জীবন কি তাঁরা ফিরিয়ে দিতে পারবেন?
জানি, তখন তাঁরা রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার কথা তুলবেন। বলবেন, রাজনীতিতে কেউ চিরস্থায়ী শত্রু হতে পারে না। ঠিক আছে, মেনে নেওয়া গেল এই যুক্তি। ভালো কথা। কিন্তু, তার পরও প্রশ্ন থেকে যায়। তা হল, তা হলে কেন সারা দেশে একমাত্র পশ্চিমবাংলাতেই রাজনীতির জন্য এ ভাবে বিভিন্ন দলের এত সাধারণ কর্মী বা সমর্থককে খুন হতে হয়?
কী বলবেন কমিউনিস্ট নেতারা? তাঁরাই তো শয়ে শয়ে বই লিখে ফেলেছেন গত শতকের সাতের দশক নিয়ে। ধারাবাহিক ভাবে প্রচার করে গিয়েছেন, ওই দশকে ‘কংগ্রেসি গুণ্ডাদের’ হাতে তাঁদের নাকি এগারোশো, নাকি বারোশো কর্মী খুন হয়েছেন!
ওই সময় তো তাঁরা কংগ্রেসকে ফ্যাসিস্ত বা আধাফ্যাসিস্ত শক্তি বলেও উল্লেখ করতেন।
আজ কি কংগ্রেস সব দোষ থেকে মুক্ত হয়ে গেল? মহান হয়ে গেল? তাই কি কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করতে অসুবিধে হল না? এর পরও আদর্শবাদের কথা বলতে লজ্জা করবে না বাম নীতি–নির্ধারকদের?
বাংলায় কংগ্রেস জমানায় যে সব বাম কর্মী খুন হয়েছেন, তাঁদের পরিবারগুলি কি আজ খোলা মনে এই লাল–সবুজ জোটকে স্বাগত জানাতে পারছে? আজ তারা যদি প্রশ্ন তোলে, যাদের হাতে ওই কর্মীরা একদিন খুন হয়েছেন, সেই তারাই আজ কী করে বন্ধু হয়ে যায়?
তার মানে, আদর্শ নয়, দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থই এখন প্রধান। সেই সহস্রাধিক কর্মীর মৃত্যু নিয়ে বাম দলগুলি (বিশেষ করে সিপিএম) নিজেদের স্বার্থই এতদিন পূরণ করে এসেছে! আজ আবার নিজেদের স্বার্থেই জোট করা প্রয়োজন, তাই জোট করছেন। বামকর্মী বা সমর্থকদের মৃত্যুর মূল্য তাঁদের কাছে বিন্দুমাত্র নেই।
তা হলে তো এ কথাও মেনে নিতে হবে, যে সব কর্মী নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থে দলে যোগ দেন, তার পর কড়ায় গণ্ডায় দল থেকে সুবিধে আদায় করে নেন, তাঁরা নিশ্চয়ই অন্যায় করেন না!
আসলে কমিউনিস্টদের আদর্শবাদ একটা ভেক ধারণা ছাড়া আর কিছুই নয়।
একই প্রশ্ন অবশ্য তুলতে পারেন কংগ্রেসি পরিবারগুলিও। বিশেষ করে বাংলায় ৩৪ বছরের বাম জমানায় যে সব কংগ্রেসি পরিবার তাদের সদস্যকে হারিয়েছে, তারা তো বলতেই পারে, এতগুলি বছর ধরে আমরা যাদের হার্মাদদের দল বলে এলাম, আমাদের পরিবারের সদস্যরা যাদের নৃশংসতার বলি হয়েছেন শুধুমাত্র কংগ্রেস করার অপরাধে, সেই সিপিএম বা বামেরা আজ কী করে কংগ্রেসের প্রাণের দোসর হয়ে গেল?
কংগ্রেসের কথা বাদ দেওয়া যাক। তারা তো গান্ধী বা নেহরু পরিবারের বাইরেও যে একটা পৃথিবী আছে, তা ভাবতেই পারে না! গান্ধী, নেহরু ছাড়া ভারত জুড়ে যে আরও অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন, দাপটে ব্রিটিশ রক্তচক্ষুকে যাঁরা উপেক্ষা করে গিয়েছেন, তা তো তারা স্বীকার করতেই চায় না।
কিন্তু বাম বা কমিউনিস্টদের সব কথাতেই তো সবসময় উড়ে বেড়ায় আদর্শের ধোঁয়া। তাঁদের বক্তব্যে উঠে আসে হাজার এক তত্ত্ব কথা। পৃথিবীতে তাঁরাই যে একমাত্র মানুষের কথা ভাবেন, সবাইকে তো সে কথা ধরে–বেঁধে বুঝিয়ে ছাড়েন! সে কথা তাঁদের আচার–আচরণেও বারবার ফুটে ওঠে। যে কোনও বিষয়েই লম্বা–চওড়া তাত্ত্বিক ভাষণ দিয়ে দিতে তাঁদের জুড়ি নেই।
ভাবতে আশ্চর্য লাগে, কমিউনিস্ট আদর্শ ছাড়া যাঁরা আর কোনও ধারণাকে স্বীকার করেন না, তাঁরা আজ নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এক সময়ের প্রধান শত্রুকেও গলায় জড়িয়ে ধরে বন্ধু হয়ে যান!
আসল কথা হল, কমিউনিস্টদের সবই মিথ্যে। আদর্শের নামে মানুষকে সবসময় বিভ্রান্ত করে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ পূরণ করে যাওয়াটাই কমিউনিস্ট বা বামেদের একমাত্র নীতি।
আগের সোভিয়েত ইউনিয়ন বা চিন, কিউবা বা আমাদের পশ্চিমবাংলা, সব জায়গায় এদের চরিত্র একই রকম। তাই ধীরে ধীরে গোটা পৃথিবীতেই কমিউনিস্টরা আজ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে।
তা হলে, স্বার্থই বড় কথা! কী বাম, বা ডান, আদর্শ নয়, ক্ষমতার স্বার্থ চরিতার্থ করাই এই রাজনীতির প্রধান উদ্দেশ্য! আর সেইজন্যই বলি হতে হয় রবীন্দ্রভারতীর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মেধাবী ছাত্র সুদীপ্ত গুপ্ত বা বাঁকুড়ার গরিব টোটোচালক মইদুলকে।